বিরহী – ওয়েব সিরিজ

প্রধান চরিত্রের জীবনের কোন বিশেষ চাহিদা নেই। কোন ইনার স্ট্রাগলও নেই। চারপাশের ঘটনা তাকে যেভাবে আন্দোলিত করে সে সেভাবেই আন্দোলিত হয়। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনাতেই সে খুশি। পশ্চিমবঙ্গের বেকার যুবক মাত্র এমনই তো জীবন। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সেই বেকার যুবক প্রেমিকার প্রিওয়েডিং ভিডিও শুট করে। দুম করে একদিন সে জয়েনিং লেটার পায়। বাড়ি থেকে অনেক দূরে বিরহী প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতে গিয়ে একেবারে অচেনা একটা পরিবেশে পৌঁছে সেখানের ঘাত প্রতিঘাত সামলে কোন মতে একটা প্রেম করে বিয়ে করে– এইটুকুই গল্প। বাকিটা পরিচালকের পরিবেশন করার গুণে বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য একটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন, করেছেন। যথারীতি তাঁর অন্য ছবির মতোই তিনি নদীয়ার গ্রাম জীবনের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ালেন। গল্প বলার দায় তিনি নেন না এবারেও নেননি। নেননি কারণ গল্প ছাড়িয়ে যখন রঙ্গ রসিকতায় ক্যামেরা আটকে থাকে তখনই বোঝা যায় পরিচালক নিজেই চান না গল্প এগিয়ে চলুক। প্রধান চরিত্র যেভাবে নতুন দুনিয়া দেখছে তার চোখ দিয়েই দর্শক অন্য গ্রামকে দেখুক। এই কারণেই প্রথম এপিসোডের পরে দ্বিতীয় এপিসোডে গল্পের গতি স্লথ হয়েছিল। তৃতীয় এপিসোড পেরিয়ে আবার পরের তিনটি এপিসোডে গল্পের গতি ফিরেছে। ষষ্ঠ এপিসোডে প্লট টুইস্টের কারণেই গল্প তড়িঘড়ি গুটিয়ে যায়, দর্শক তৃপ্তির সঙ্গে রাধা কৃষ্ণের প্রেম যেমন উপভোগ করে তেমনি বিপরীতে একজন ধর্ষক ও খুনি ট্যাঁপার প্রতি তার স্ত্রী জমিদারের আনুগত্য ও প্রেম দেখে ভেবলে যায়। অনেক চেষ্টা করে বিরহী প্রাইমারি স্কুল থেকে বদলি হয়ে কৃষ্ণ ফুলকুমারীতে জয়েন করার পরেই রেডিওতে ঘোষণা হয় কোর্টের অর্ডারে সমস্ত বদলি বাতিল করা হয়েছে। যথারীতি দ্বিতীয় এপিসোডের সম্ভবনা তৈরি করে প্রথম সিজন শেষ করা হয়। এই ওয়েব সিরিজের বড় শক্তি এর সেটিং। ড্রয়িং রুম ড্রামার দম বন্ধ করা সিনেমা পরিসর থেকে বেরিয়ে চরিত্ররা পথে ঘাটে বাসে অটোতে গ্রামজীবনে ঘোরাফেরা করে। চোখের আরাম, দেখার শান্তি লাভ করতে হলে বিরহী দেখতে হবে। আর বড় শক্তি সিরিজের আবহ আর গান। সাত্যকী ব্যানার্জী এর আগেও প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যর ছবিতে আবহ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু এই কাজটার মাত্রা এখনও পর্যন্ত প্রথমে থাকবে। ডিভোর্সী রাধা ও প্রেমে প্রত্যাখ্যাত কৃষ্ণর আলাপ থেকে বিবাহ পর্যন্ত কীর্তনের ব্যবহার দৃশ্যগুলোতে অন্য মাত্রা যোগ করেছে। শুকপাখি গানটির প্রয়োগ যে বিষাদকে ছুঁতে চায় তা সমসময়ের বেকার বা সকার যুবক যারা পরিস্থিতির দাস হয়ে অসহায় জীবন যাপনে বাধ্য হয় তাদের বিষাদকে ছুঁতে পেরেছে বলেই মনে হয়। তবে একাধিকবার প্রয়োগে সেটাও একঘেয়েমি তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে বলতে হয়, “বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস অল্প বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি।”যেমন এই সিরিজের ভায়োলেন্সের দৃশ্য ছবিকে সমৃদ্ধ করে না। দৃশ্যগুলো না থাকলেও কোন অসুবিধা হত না। যৌন উত্তেজনাবর্ধক ঔষধের কারবারিকেও তাই একসময় একঘেয়ে লাগে। একঘেয়েমি তৈরি করে বাসের সহযাত্রী। অনেক সময় ড্রোনের ব্যবহার ভালো লাগেনি, অনেক সময় মনে হয়েছে সন্ধ্যে বেলায় কোন প্রাইমারি স্কুল খোলা থাকে, বাসস্ট্যান্ডে কোন বান্ধবী বন্ধুকে প্রকাশ্যে জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করে— তবু এ সব দৃশ্যই সত্য হয়ে ওঠে উপস্থাপন করার গুণে। জমিদার ট্যাপা কৃষ্ণ রাধা বলাইদা প্রত্যেকেই সাবলীল। অভিনয়ের চরিত্রগুলো চেনা মনে হয়, তাদের ঘামের গন্ধ ফ্রেম ছাড়িয়ে যায়। সায়ন ঘোষ কৃষ্ণ চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। জমিদার চরিত্রই সিরিজের মূল আকর্ষণ – শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য নিংড়ে দিয়েছেন নিজেকে, অনেক সময় তার একসেন্ট আরোপিত মনে হয় তবুও সে নিজের জায়গা ছেড়ে দেয়নি কাউকে। রাধা চরিত্রে পুরুষালি অভিব্যক্তি আরোপ গোটা সিরিজটার অন্যতম জোরের জায়গা। মুশকিল হল চরিত্রের কোন ইনার কনফ্লিক্ট বা বিশেষ চাহিদা না থাকলে চরিত্রের পক্ষে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা খুব কঠিন। রাধাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে শতাক্ষী নন্দী চেষ্টা করেছেন অনেকটাই। ট্যাঁপা খুনি হলে ক্ষতি ছিল না, ধর্ষণ করেছে বলা মাত্রই চরিত্রের যে অবস্থান থাকে তা নড়বড়ে হয়ে যায়। তার স্ত্রী পুত্র অন্তিম এপিসোডে তার পাশে দাঁড়ালে মনে হয় একটা মিথ্যা অন্তত সে বহন করছে। যদিও একটি এপিসোডেও এই মিথ্যা ঘোচাতে তৎপরতা দেখায়নি। মজা হল এমন চরিত্রে অমিত সাহা চমৎকার কাজ করে বেরিয়ে আসেন। তবে ভালো শিক্ষক হয়ে উঠতে বা ক্লাসে ছাত্র ছাত্রীদের টেনে আনতে যে ধরনের আনন্দ দায়ক পরিবেশ গড়ে তোলার দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে তার একটুকরো দেখালেও সিরিজটা অন্যরকম হতে পারে পরের সিজনে। ভালো শিক্ষক স্কুলে জয়েন করা মানেই সমাজে আলোড়ন উঠতে বাধ্য। সেটা কেমন করে পরিচালক দেখাবেন সেটাই এখন দেখার।
দ্বিতীয় সিজন দেখাতে পারে
১ রেজিস্ট্রার উদ্ধার ও জমিদারের এন্ট্রি

২ নেশামুক্তির চোটে গ্রামে নতুন দ্বন্দ্ব

৩ ধর্ষক ও খুনি পরিচয় থেকে ট্যাপার নিষ্কৃতি

৪ কৃষ্ণ ও রাধার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব তাদের হবু সন্তান বিরহী স্কুলেই পড়বে নাকি… ইত্যাদি ইত্যাদি
ওয়েব সিরিজ – বিরহী

কাহিনী চিত্রনাট্য সম্পাদনা পরিচালনা প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য

চ্যানেল উরিবাবা

Leave a comment

Website Built with WordPress.com.

Up ↑