তথ্যচিত্র- চর

নদী, তুমি কোন কথা কও?

নদীই এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। যে ভাঙে গড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বাঁচিয়ে রাখে। ভিটে মাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে কিছু মানুষ ভূতে পাওয়ার মতো লগি ডুবিয়ে জল মেপে দেখার চেষ্টা করে কোথায় জেগে উঠছে নতুন চর। চর জেগে উঠলে ম্যাপ আর স্মৃতি আশ্রয় করে আবার জায়গা দখলের চেষ্টা করে। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির কাছে অবস্থিত এমনি একটি চরের ছেলে রুবেল। যারা চরের জীবনযাপনকে মেনে নিয়ে জীবন কাটায় তাদের একজন সে– ছবির একজন কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার মা বাবা দিদি ছাড়াও আছে প্রতিবেশী দুটি দেশ ভারত ও বাংলাদেশের র মধ্যে গরু চাল ফেনসিডিল পাচার করে জীবিকা নির্বাহ করেন এমন নারী পুরুষ। আছে আজানের ভেসে আসা সুর, আছে সন্তান হারা মা, আছে পরিচয় পত্র হারানো মানুষ, আছে দুই দেশের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স। অতিনাটকীয় হয়ে উঠতেই পারত সব মিলিয়ে তবু জীবন নদীর মতই বয়ে চলে। নদীর সর্পিল গতিকে ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে বাঁধতে চেয়েছে মানুষ। সাপ বাধা পেয়ে লেজ ঝাপটায়, মালদায় মূর্শিদাবাদে বন্যা ছোবল মারে। তীর ভেঙে যায়। মানুষ মনসা মঙ্গল শুনতে ভীড় করে। সাপে কাটা রুগীর সামনে নেচে ওঠে ওঝা। ভরা ফারাক্কায় আলো পড়ে গঙ্গা ঝিকমিক করে ওঠে সাপের মত। ততদিনে রুবেলের দিদি শাকিলাকে প্রায় পরিত্যাগ করেছে তার স্বামী। জল সাপ নদীর মিথ, মনসার মিথ, মানুষ আর জীবন একাকার হয়ে যায়। বুকে পেটে পাছায় ফেনসিডিল বেঁধে মেয়েদের দল বীরদর্পে এগিয়ে যায় বি এস এফের দিকে। পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে গরু নিয়ে জলে সাঁতার কাটে মানুষ। গুলির শব্দ শোনা যায়। ঘুমন্ত রুবেল পাশ ফিরে শোয়। সূর্য ওঠে। বৃষ্টি পড়ে। একদিন হলেও রুবেল স্কুলে যায়। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জীবনী পড়ে। আর তার কৈশোর কাটে ধূ ধূ বালির উপর চালের বস্তা বোঝাই সাইকেল ঠেলে। ভাঙন, বন্যা, রুবেল, চাল পাচার, ফেনসিডিল উদ্ধার, গরুপাচারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রুবেল নদীকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, বলে : ভালো সময় আসবে একদিন। পরিচালকই ছবির কথক। মান্য চলিত ভাষায় একমাত্র তিনিই এই ছবিতে কথা বলেছেন। বাকি সবাই কথা বলেছেন ঐ বিশেষ অঞ্চলের উপভাষায়। ফলে কথক আর বিষয়ের মধ্যে পারস্পরিক সৌজন্যমূলক দূরত্ব বজায় থেকেছে। তথ্যচিত্র বলা হলেও ‘মধ্যিখানে চর’ শেষ পর্যন্ত ছবির ভাষায় কথা বলে নিজেকে বাঙ্ময় করে তুলেছে। রুবেলের বাড়ির প্রতিটা দৃশ্য এই ছবিতে গল্পের বাঁক বদলে দিয়েছে। ছবির অনেক দৃশ্য কাব্যিক। কিন্তু পরিচালক নিজেই জানিয়েছেন এই ছবির একাধিক এডিশন তৈরি করেও তিনি ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কাব্য নয়, বিষয়কে রক্ত মাংসের মত হাজির করতে চেয়েই এই পথ অবলম্বন করেছেন তিনি। ছবির শেষ সিকোয়েন্সে যখন চরের বুকে ফলন্ত গমের শীষ হাওয়ায় নড়ে চড়ে তখন যথারীতি মনে পড়ে যায় তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ঋত্বিক ঘটকের ছবির শেষ দৃশ্যের কথা। তিতাসের বুকে চর জেগে উঠেছে। সেখানে নতুন ফসল হাওয়ায় দুলছে আর তার ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে একটা শিশু, ভেঁপু বাজাতে বাজাতে। রুবেল হারবে না। রুবেলরা হারতে জানে না। তাই তার নির্ভীক উচ্চারণ: ‘চরের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, কিন্তু আমার কিছু না কিছু ঠিক হয়ে যাবে।’ ছবিটি আমাদের দেখতে হবে দুটি কারণে। প্রথমত, শুধু রুবেল নয় এই ছবির প্রতিটা চরিত্র আমার রাজ্যের মানুষ, আমাদের প্রতিবেশী দেশের মানুষ, এবং প্রতিদিন ভিটে মাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় যাদের তেমন মানুষ। তারা যেন সোচ্চার বলছেন ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ. এই কী মানুষজন্ম?’ আর দ্বিতীয়ত, ক্লাইমেট রিফিউজি মানুষ কিসের টানে চরেই থেকে যায়, মানুষের মনে কেমন করে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার জিদ কাজ করে তা বুঝতে ছবিটা দেখে নিতে হবে।

নন্দন ২ তে ছবির অনেক শব্দ যথাযথ শুনতে না পাওয়ায় ছবি দেখার সুখ নষ্ট হয়েছে। টাইটেল কার্ড উঠছে, ছবি একটা সুরে বেঁধে শেষ হচ্ছে তারা মাঝখানে ঝপাঝপ আলো জ্বালিয়ে দেওয়াতেও যথেষ্ট বাজে লেগেছে। তবু ভালো কর্তৃপক্ষের বদান্যতায় ছবিটি এতদিন পর টিকিট কেটে দেখার সুযোগ হল।

তথ্যচিত্র- মধ্যিখানে চর (২০১২)
Char… The No-Man`s Island (A)

পরিচালক- সৌরভ ষড়ঙ্গি

One thought on “তথ্যচিত্র- চর

Add yours

Leave a comment

Website Built with WordPress.com.

Up ↑