বীরভূমের হাটসেরান্দি পটের দুর্গার জন্য বিখ্যাত। আর গত এক দশকে অনেকবার চেষ্টা করেও পৌঁছতে পারেনি এই অধম। কারণ একটাই। “কাছে এল পূজার ছুটি। রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপাফুলের রঙ। হাওয়া উঠছে শিশিরে শির্শিরিয়ে”… এই আহ্বান কোন প্রবাসী অস্বীকার করতে পেরেছে। দেশের বাড়িতে ছুটে এসেছি তাই ছুটি ঘোষণা হতেই। এবার লকডাউনের আগে ছাত্র ছাত্রীদের মিড ডে মিল দেওয়ার কথা মনে পড়ল না সরকারের। অঘোষিত ছুটি হয়ে গেল আগেই। চলে গেলুম একদিন। সময় নিয়ে গিয়ে ফিরে এলুম তিনটি বাড়ির কাজ দেখে। এখন একদিনে কাজের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছি। আনন্দই যখন একমাত্র প্রাপ্তি তখন রয়ে সয়ে নেওয়াই ভালো। পট আঁকা হয়ে গেছে সব বাড়িতেই।ছবির পটটি হাটসেরান্দির গড়ে পাড়ার ঘোষ-মন্ডল পরিবারের। এঁকেছেন শিল্পী রত্নাকর মেটে। তার বাড়ি গান্দপুরে। চারটে পরিবার চাষ আবাদ করেই গত দুশ বছর এই পুজো আনছেন। দেবোত্তর সম্পত্তি কিছু নেই। ছিলও না কোনোকালে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ সমীরণ ঘোষ তথ্য দিয়ে সাহায্য করলেন। আমন্ত্রণ জানালেন, বললেন ‘পুজোর সময় আসতেই হবে। আর সাজানো প্রতিমা দেখতে হলে আসুন ষষ্ঠীতে।’
“আগে পট আঁকতেন আদর গোপাল সূত্রধর। উনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। উনার ছেলে তো কোনদিন রংতুলিতে হাত দেয়নি। বাবা অনেকবার বলেছিল। হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিল তু মায়ের পটটা একবার আঁক। সে বছর উনি পারলেন না। আমরা অন্য শিল্পীকে দিয়ে পট আঁকালাম। অষ্টমীর দিন, তখন আরতি হচ্ছে, উনি এইখানে এসে পড়লেন। মা স্বপ্ন দিয়েছে, তুই পট আঁকিস নি তো কী হয়েছে! আমার কাছে তো আয়। ঠিক একমাস পরে উনি মারা গেলেন। গতবছর উনার ছেলে রামকৃষ্ণ হঠাৎ এসে হাজির। কাকা আমি কিছু নেব না পটটা আমাকে করতে দাও। মা আমায় স্বপ্নাদেশ দিয়ে পাঠিয়েছে। আমরা বললাম তু জীবনে রং তুলিতে হাত দিসনি, তুই কি করে পারবি? মায়ের পট নিয়ে ছেলেমানুষী করিস না। শুনলে না। আমরা বিশ্বাস করে রাজি হলাম। হয়তো বাবার মত পারেনি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এইটা ও আঁকতে পারছে।” কথা হচ্ছিল হাটসেরান্দির জয় গোপীনাথ ফার্মেসির উল্টো দিকে অবস্থিত রায় বাড়ির মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে। গল্প বলছিলেন শিবনাথ রায়। তাদের প্রায় 300 বছরের পুজো। এখন চাষাবাদ করেই পুজো হয়। আগে ধুমধাম হত কিছুটা জমিদারি ছিল বলে। তিন পুরুষ আগেই সব খুইয়ে বসেছিলেন দাদুরা। কিছুদিন আগেও নহবত বসত। বাজনদারের অভাবে গেল বছর থেকে সানাই বন্ধ হয়েছে। রায় পরিবারের দালান মন্দিরটি দোতলা। উপরে থাকেন নারায়ণ, নিচে লক্ষ্মী। দুর্গা পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। পশু বলি হয় না। তবে আখ কুমড়ো ও চিনি বলি হয়। অষ্টমীর দিন দোল নিয়ে ঢাকঢোল সহযোগে গ্রাম পরিক্রমা হয়।দীর্ঘদিন পরিবারের পক্ষ গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবার ও সম্মানীয় ব্যক্তিদের আমান্য দেয়ার রীতি মেনে চলা হচ্ছে। আমান্য দেওয়া হয় প্রায় পঞ্চাশ জনকে। তাতে থাকে আতপ চাল এক পোয়া, ফলমূল, কদমা আর নবাত। গল্পের পরে একটি বাঁধানো ছবি এনে দেখালেন শিবনাথ বাবু। আদরগোপাল সূত্রধরের আঁকা পটের ছবি মিলিয়ে দেখলাম, তাঁর পটের দেবীর ভাব ও ভঙ্গীর মতো করেই ছেলে আঁকার চেষ্টা করেছে । তিনি নিজের মনের মত করে দেবীকে এঁকেছিলেন। দীর্ঘদিন ঐভাবেই আঁকতেন। এখন তাঁর পুত্র বাবার মত করেই দেবীকে দেখতে চাইছে। শিল্পীর রেখা ও রঙের আয়োজন দেখে বোঝাই যায় এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে রামকৃষ্ণবাবুকে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বললেন শিবনাথ বাবু, ‘শেষ পর্যন্ত ও যে কাজটা শুরু করেছে এই অনেক। মা চাইলে ও একদিন বাবার মতই শিল্পী হয়ে উঠবে।
Leave a comment