কী খুঁজে ফিরেছি ছবি আর লেখাতে

 

Coverগ্রন্থ শিরোনাম- ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে
লেখক- সুব্রত ঘোষ 
প্রথম প্রকাশ- নববর্ষ, ১৪২৫
প্রকাশক- অভিরুপ সেন,
নিষাদ, বি- ১২, রামগড়, ফ্ল্যাট টু-এইচ, কলকাতা- ৭০০০৪৭
দাম – ৩০০ টাকা

বইটি কিনুন এই লিঙ্ক

(আগামীকাল  – সাইটে এই লেখাটি পড়ুন )

“বাঙালীর ধর্মকর্মের গোড়াকার ইতিহাস হইতেছে রাঢ়-পুণ্ড্র-বঙ্গ প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদগুলির অসংখ্য জন ও কোমের, এক কথায় বাঙলার আদিবাসীদেরই পূজা, আচার, অনুষ্ঠান, ভয় বিশ্বাস, সংস্কার প্রভৃতির ইতিহাস।” বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব), নীহাররঞ্জন রায়, পৃ.৪৭৮

       উদ্দেশ্য ছিল বাঁদনা পরব, গাজন, জাদু বিশ্বাস প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করব। বছর দুয়েক যেতে না যেতেই তিনটে কাজ মাঝপথে থেমে যায়। বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাজেট এবং সময়। তখনই বুঝতে পারি লিখে না রাখলে  হারিয়ে যাবে ভাবনাগুলো। লেখার কাজ শুরু করতে দেখলুম ভিডিও যথেষ্ট থাকলেও বিষয়গুলির স্থিরচিত্র নেই প্রয়োজন মত। এমন সময়ে নিষাদের পক্ষ থেকে আমায় আহ্বান জানান হয় এমনই কিছু বিষয় নিয়ে লিখতে। দেখলুম আমাদের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের বিচিত্র ধারাকে এক মলাটে ধরতে হলে নির্বাচন করতে হবে কিছু নতুন বিষয়। নটি বিষয় থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে জায়গা পেল-  ভাঁজো; করম পরব; বাদনা পরব; গাজন; পটের প্লটে যম এবং অন্যান্যরা; সত্যনারায়ণ, সত্যপীর এবং মাখদুম সাহেবের মাজার। লিখলুম, ‘ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে’।

IMG-20180718-WA0006.jpg

 

টোটো, অটো, বাস, ট্রেন, মোবাইল ফোন, সোশ্যাল সাইট আর ই-লাইব্রেরির যুগে দাঁড়িয়ে   ঝাঁপিয়ে পড়াই যায় এমন কাজে। কিন্তু প্রশ্ন হল কেমন করে দেখাব এই সংস্কৃতিকে। প্রথামাফিক ‘লোকসংস্কৃতি’ বলে দিলেই ক্ষুদ্র পরিসরে বেঁধে দেওয়া হয় বিষয়গুলিকে; এবং ‘হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের পটচিত্র’ ইত্যাদি বলে কাঁদতে বসতে হয়। অথচ দেখলুম আনন্দে ভেসে যাচ্ছেন সবাই পরবের দিনে। নিজের খেয়ালে আঁকছেন কেউ নতুন ধারার পট। অনবরত নতুন ছড়া বানিয়ে শোনাচ্ছেন কেউ। কেউ বা সারাদিন ফ্যাক্টরিতে কাজ করে সন্ধ্যেয় যোগ দিচ্ছেন রিহার্সালে। শুধু আচার অনুষ্ঠানকে দেখলে ভুল হওয়ার সম্ভবনা থেকে যায়। বিশ্বাস ছাড়াও আছে তাদের নিজস্ব প্রকাশের জগত, আছে সমাজ সম্মিলনের প্রশ্ন। আমরা নির্বাচিত বিষয়ে এই জায়গাগুলিতেই জোর দিয়েছি অনুসন্ধিৎসুর মত।
সংস্কৃতি অবিরত পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে পথ হাঁটছে। কোন একটি পরব বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে একেবারে অক্ষতরূপে পাওয়া এখন দুঃসাধ্য। আরও দুঃসাধ্য সেইটুকু দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তাই ‘অনুমান করা হয়’, ‘আমাদের অনুমান’, ‘মনে করা হচ্ছে’ ইত্যাদি কথার ছড়াছড়ি। আগ্রাসী প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির কামড় এড়িয়ে নির্বাচিত বিষয়গুলি কেমন করে টিকে আছে, এই সময়ে তাদের স্বরূপটিই বা কী? তাই ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় প্রত্যেকটি বিষয়কেই অডিও ও ভিস্যুয়াল মাধ্যমে আলাদা আলাদা রেকর্ড করা হয়েছে। তারপর অভিজ্ঞতাকে যথাযথ নথিভুক্ত করেছি ব্যাক্তিগত প্রবন্ধের আকারে।

ভাঁজো একটি কৃষিকেন্দ্রিক ব্রত। করমও। কিন্তু দুটি ব্রতের মধ্যে এমন কিছু পার্থক্য আছে যা ব্রত দুটির উৎস সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞাসু করেছে। মেহেরগড়ের কৃষি সভ্যতা সম্পর্কে আমরা জানি। কিন্তু বর্ধমান বীরভূমের অজয় নদের তীরে হরপ্পার সমসাময়িক যে কৃষি সভ্যতা ছিল তা সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ কম। আমরা বাংলায় কৃষি সমাজের আবির্ভাবকে দেখতে চেয়েছি দুটি ব্রতের ভিতর দিয়ে। এবং দেখতে গিয়েই ‘বাদনা পরবের’ সম্মুখীন হয়েছি গভীর বিস্ময়ে। এতবড় একটা উৎসবে বাঁকুড়া পুরুলিয়া মেদিনীপুর বর্ধমান বীরভূমের আদিবাসী সমাজ মেতে ওঠে! শিব কেমন করে ‘বুঢ়াবাবা’ হয়ে কৃষককে সাহায্য করলেন, কেমন করে শিব হয়ে উঠেছেন সবার দেবতা তা বুঝতে সাহায্য করবে বাদনা পরব সম্পর্কে লেখাটি। এই গ্রন্থের চতুর্থ প্রবন্ধ গাজন। গাজন সরাসরি অভিপ্রয়ানের সঙ্গে সম্পর্কিত বলেই আমাদের সিদ্ধান্ত। কৃষিসমাজেরও আগে যে মানুষরা বাংলার বুক দিয়ে হেঁটে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছেছিলেন তাদের আচার অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ এখনও থেকে গেছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব গাজনে। এই প্রবন্ধেই আমরা সন্ন্যাসীর হাতের ছড়ি সম্পর্কে একেবারে নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যা তর্কের পরিসর বাড়াবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

বাংলার পটচিত্র নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। আমাদের দীর্ঘ প্রবন্ধে আমরা এই মুহূর্তের এমন কয়েকজন পটুয়ার সঙ্গে কথা বলেছি যে যারা এখনও পটের গান গেয়ে ভিক্ষা করে জীবন অতিবাহিত করেন। যাদের গানে ও পটে এখনও ধরা আছে বাংলার সাংস্কৃতিক নির্মাণের ইতিহাস। বাংলার সমন্বয় সাধনায় পটচিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। সেই পটের সূত্রেই আমরা পৌঁছেছি সত্যপীরের পাঁচালী ও বাংলার প্রাচীন সূফী খানকায়।
এই কাজগুলির জন্যে যারা অবিরত সাহায্য করেছেন, কথা বলেছেন, নতুন কারও কাছে জোর করে নিয়ে গেছেন- তাদের কথা অনিবার্য ভাবে এসে গেছে লেখাগুলিতে। তাদের আবেগ, তাদের অভিযোগ, তাদের উপলব্ধি, তাদের ইতিহাস চেতনা যথাযথ ভাবে তুলে ধরাটাই ছিল কঠিন কাজ। লেখাগুলি প্রয়োজন মত তাদের শুনিয়ে ও পড়িয়ে সংশোধন করা হয়েছে। তার পরেও এলাকা ভেদে মত পার্থক্য ঘটা সম্ভব। এবং সেটাই স্বাভাবিক। অবশ্যই বিষয়গুলি নিয়ে ইতিমধ্যে  অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে লেখা ও ‘ফটো এসে’র কাজ কেউ একসঙ্গে করেছেন এমন এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। ‘ফটো এসে’র জন্যে অল্প পরিসরে তথ্যকেন্দ্রিক লেখা লিখতে হয়। এই বইয়ে তা না করে দীর্ঘ আলোচনার শেষে ছবিগুলি রাখা হয়েছে। তাতে সুযোগ তৈরি হয় ছবিগুলি নতুন করে দেখার ও পড়ার।

বইটির একমাত্র উদ্দেশ্য এই সময়ের বাঙালীকে নিজের অতীত ও বর্তমানের ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলা। কোন নস্টালজিয়া সৃষ্টি এর উদ্দেশ্য নয়। একটা চলমান সংস্কৃতি কেমন করে পড়ব তা নতুন করে ভেবে দেখার সময় হয়েছে। কয়েকটি বা কয়েকশ তথ্য শ্রেণীবদ্ধ করে এতদিন আমাদের জনজীবনের ধারাকে ‘লোক’ নামের ক্ষুদ্র পরিসরে রেখে অন্যায় করা হয়েছে। শ্রেণীবদ্ধ তথ্যে কোথায় ধরা পড়ে তার জীবনের চালিকা শক্তি, কোথায় ধরা পড়ে তার আত্মপ্রকাশের অহংকার? -প্রত্যেকটি বিষয়েই চেষ্টা করেছি সেই অনালোচিত বিশেষ দিকটিকে চিহ্নিত করতে। কতটা সফল হয়েছি একমাত্র পাঠকই বলতে পারবেন। পাঠ উপভোগ করুন, বিনিময় করুন মতামত। নতুন তর্কের পরিসর তৈরি করতে পড়ে ফেলুন ‘ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে’।

 

Cover (2)
বুক কভারঃ ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে প্রচ্ছদ- হিরণ মিত্র
IMG-20190521-WA0004
আনন্দবাজার পত্রিকায় সমালোচনা ২১-০৫-২০১৯

Leave a comment

Website Built with WordPress.com.

Up ↑