জীবনে যৌবনে

মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৮০% পাওয়ার পর ঝপ করে ৫৩% তে নেমে এলুম উচ্চমাধ্যমিকে। কি পড়ব? কলেজ মিলছে না। রিষড়া কলেজে ফর্ম তুলতে গিয়ে দেখি বম পড়ছে। পালা পালা। ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে পালাতে আমি আর হাবিবুর সেদিন রিষড়া থেকে বালি ব্রিজ অবধি হেঁটেছিলুম। হাবিবুর কমার্স পড়তে চায়, আমি ইংরেজি অনার্স। ওর নম্বর ভালো আছে, হরিপাল কলেজে হয়ে যাবে। আমার ঘরের কাছে কোথাও হবে না। বিচ্ছেদ হবেই এবার আট বছরের বন্ধুত্বের। পরদিন গেলুম কোন্নগরে। বাংলা অনার্সের ফর্ম পেলুম একবেলা দাঁড়িয়ে থেকে। ইংরেজি জুটবে না? আবার রিষড়া কলেজে গেলুম বলাইবাবুর চিঠি নিয়ে। উনার বন্ধু ওখানে ইংরেজি পড়াতেন। দেখা করলে চিঠি পড়ে বললেন, ওয়েট কর একটু। দুপুরে ভর্তি হয়ে বাড়ি যাবে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কি মনে হল বাড়ি চলে এলুম। কারো অনুগ্রহে ভর্তি হতে মন সায় দিচ্ছিল না। দিন পনের পর কোন্নগরে গিয়ে দেখলুম নাম বেরিয়েছে বাংলা অনার্সে। কিন্তু পাশ সাবজেক্ট ফিলোসফি, পলসাইন্স নিতে হবে। জয় মা বলে ভাসিয়ে দিলুম তরী। একা একাই একটা নতুন কলেজে, অচেনা শহরে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা একটাই রুটিন। ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বের হতুম আটটা দশ পনেরয়। সাইকেলে কুড়ি মিনিটে স্টেশন। সাড়ে আটটার ট্রেন, ট্রেনে একঘণ্টা গিয়ে পনের মিনিট হেঁটে কলেজ। অতদুর বলেই গিয়ে ফিরে এসেছি খুব কম দিন। একটা ক্লাস হলেও ক্লাস করে সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরতুম। হাত খরচ পেতুম ডেলি দশ টাকা। একটাকা সাইকেল গ্যারেজ ভাড়া। পাঁচ টাকার টিফিন দুপুরে। বিকেলে চারটাকার টিফিন। বই পড়ার নেশা ছিল খুব। ক্লাস করারও। একটাই প্রাইভেট টিউশন নিলুম। অনার্সের। শেওড়াফুলিতে। ডঃ সৌমেন দাশ। খুব ভালবাসতেন স্যার। পড়া থাকলে ভোর ছটায় বেরিয়ে পড়ে কোন্নগর স্টেশনের ধারে ভাত খেয়ে আমি মানস নির্মল হাঁটতে হাঁটতে কলেজ পথে পা বাড়াতুম। হাঁটতে হাঁটতেই সিগারেট ধরলুম। তারপর বিড়ি। যে আশঙ্কায় বাড়ির লোক হোস্টেলে থাকতে দিল না সেই আশঙ্কাই সত্যি হল। মদ খাওয়াই বা বাদ থাকে কেন! এরপর এল গাঁজা। কৌতূহল বশত খেতে খেতে দেখলুম বিড়ি সিগারেট না হলে চলছে না। অকেশনালি মদ খাচ্ছি। আর মর্নিং শোতে শ্রীরামপুর টকিজে দেখছি এডাল্ট ফিল্ম। প্রতি সপ্তায় সেইসব নতুন ছবি দেখা চাই। টিউশন পড়িয়ে একশ টাকা জুটত প্রতি মাসে। টুকটাক ছবি এঁকে এর ওর খাতা কপি করেও ইনকাম হত। ঐ সময় আমি সুমন্ত আর পলাশ বাড়ি বাড়ি সেন্ট বিক্রি করে বেশ ভালো টাকা কামিয়েছিলুম দুবছর। সুমন্তদের বাড়ি ছুটির দিনে দাবার বোর্ডে রাজা মন্ত্রী ঠেলতে কত বড় বড় কোম্পানি যে আমরা তৈরি করেছিলুম! কোটিপতি লাখপতি হয়ে ইউরোপ আমেরিকা ঘুরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যেত। লোকের কারেন্টের বিল জমা দেওয়ার কোম্পানি খুলেও লাভ হল না। পাঁচজনের টাকা জমা দিয়ে একটা রসগোল্লা দুটো স্লাইস রুটি হয়না তিনজন কর্মচারীর। নিকুচি করেছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেও সব বাতিল হয়ে গেল নানা কারণে। অতএব নিয়মিত নাকে মুখে দুটো ভাত গুঁজে দিয়ে সাইকেল চালাতুম সাঁই সাঁই করে। গ্যারেজে সাইকেল ফেলে দিয়ে গৌতমদার দোকানে একটা ফ্লেক ধরিয়ে ছুটতে ছুটতে ট্রেনে ওঠার সেইসব কৈশোরের দিনগুলো! আহা! মানস দাঁড়িয়ে থাকত গেটে। নির্মল। সমীর। সিগারেট ভাগ করে নিত বন্ধুরা। এরপর একঘণ্টা পড়াশোনা। ট্রেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বই পড়তুম। একঘন্টায় তিরিশ পাতা পড়বই। যেতে আসতে ষাট পাতা। গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নাটক সব ঐ ট্রেন পথেই যেতে আসতে পড়তে হত। বাড়ি এসে ক্লাবে ক্যারাম পেটা, যাত্রার রিহার্সাল দেওয়া, হাবিবুরকে নতুন লেখা কবিতা শোনাতে যাওয়া বা শ্রাবণী বৌদির সাথে শ্রুতি নাটকের রিহার্সাল সামলে পড়ব কখন? যাত্রা বা দুর্গাপূজার সময় একমাস চাঁদা চেয়ে বেরিয়েই সন্ধ্যে খতম হয়ে যেত। সেকেন্ড ইয়ারে জীবনে প্রেম এল দ্বিতীয় বার। বাড়ির ল্যান্ড ফোনের বিল প্রেমের প্রথম তিনমাসে এত বেশী এল যে বাবা ডেকে বলল, সিঙ্গুর স্টেশনে গিয়ে কথা বলে আসলে সংসারের উপর চাপ কম পড়বে। মাত্র দশ টাকা যেতে আসতে, ফোনের কি দরকার। অতএব বাড়ল চিঠি লেখা। প্রেম পত্র লিখলে কলম ধারাল হয়। সেই ধারেই পার্ট ওয়ানে ৫২% পেয়ে উতরে গেলুম। পার্ট টু তে সবমিলিয়ে থাকল ৫৩.৫%। কিন্তু ততদিনে প্রেমিকা জানিয়েছে সম্পর্কটার শক্তি ফুরিয়েছে। আমার বাল্যপ্রেমিকা যেমন প্রেম কেন ফুরিয়ে গেছে বুঝতে না পেরে একা একা ফিরে চলে গিয়েছিল বাড়ির পথে, আমিও দেখলুম এক নিরানন্দ আমি ইউনিভার্সিটির গেটে এমএ তে ভর্তির রসিদ হাতে একা দাঁড়িয়ে আছে- একমাত্র ফুটপাতে পড়ে থাকা দু চারটে বই ছাড়া চেনা কেউ নেই তার হাতের নাগালে।

Leave a comment

Website Built with WordPress.com.

Up ↑