অথবা তা এডিথ, মলিনা নাম্নী অগণন নার্সের ভাষা

দেশপ্রেমই শেষ কথা নয়। আমার যেন কারো প্রতি কোন ঘৃণা বা তিক্ততা না থাকে।’ ‘Patriotism is not enough, I must have no hatred or bitterness towards anyone.’— মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ১৯১৫তে এমন কথা বলতে পেরেছিলেন নার্স এডিথ ক্যাভেল। তাঁর সহমর্মিতা ও সাহসিকতাকে সম্মান জানিয়ে কানাডায় একটা পর্বতের নাম রাখা হয়েছে মাউন্ট এডিথ ক্যাভেল। বেরিয়েছে ডাকটিকিট। নার্সিং প্রফেশনে আছেন অথচ তাঁর কীর্তি জানেন না এমন কেউ বিরল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নানা কারণে প্রায় দেড় হাজার নার্স মৃত্যু বরণ করেন। এডিথ ক্যাভেল তাঁদের একজন হয়েও অনন্যা। সমকালে বাংলাদেশের এক উদীয়মান কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘মনোকণিকা’ কবিতায় এডিথের নাম উল্লেখ করেছেন। একটি শিরোনামহীন কবিতায় তাঁকে বসিয়েছেন গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে এক সারিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তর পৃথিবীতে মানবিক অনুভূতি সম্পন্ন মানুষরা বার বার উচ্চারণ করেছেন এডিথ ক্যাভেলের শেষ কথা- ‘Patriotism is not enough, I must have no hatred or bitterness towards anyone. I can’t stop while there are lives to be saved.’

এডিথ ক্যাভেলের জন্ম ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে, লন্ডন থেকে একশ মাইল দূরের নরিচ শহর সংলগ্ন সদরস্টন গ্রামে। নিজের অসুস্থ বাবার পরিচর্যা করতে গিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নার্স হবেন, হয়েও ছিলেন। তিরিশ বছর বয়সে লন্ডন হসপিটালে নার্স হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাসেলসে একটি নার্সিং স্কুলে ম্যাট্রনের দায়িত্ব নিয়ে কাজে যোগ দেন। ১৯১০ এর মধ্যে তিনি এতটাই অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষন নার্স হয়ে ওঠেন যে নার্সদের জন্যই একটা নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ জরুরী মনে করেন। ১৯১১এর মধ্যেই তিনি বেলজিয়ামের পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন- কারণ ততদিনে তিনি তিনটি হসপিটাল ও চব্বিশটি নার্সিং স্কুলেরশিক্ষিকা এবং নার্সদের পত্রিকা লাফামিয়ার সম্পাদিকা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর স্কুলটি রেড ক্রস সোসাইটি অধিগ্রহণ করলে সেখানেই তিনি কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ইতিমধ্যেই জার্মান সৈন্য ব্রাসেলস দখল করে। একজন নার্স হিসেবে মনের মধ্যে সামাজিক বৈষম্য লালন পালন করা এই পেশায় নীতিবিরুদ্ধ। আহত মুমূর্ষু সৈন্যের পরিচর্যার ক্ষেত্রে এডিথও যেমন দেখেননি কে শত্রু কে মিত্র তেমনি বন্দী সৈন্যদের যখন পালাতে সাহায্য করেছেন দেখেননি কে কোন দেশের সৈন্য। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের প্রায় ২০০জন সৈন্য ও সাধারণ নাগরিককে পালাতে সাহায্য করে জার্মান মিলিটারি আইন ভঙ্গের অপরাধে গ্রেফতার হতে হয় তাঁকে। দশ সপ্তাহ তিনি জেলে কাটান। বিচারকার্য চলাকালীন নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিলে মিলিটারি আদালতে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি ঘোষণা করা হয়। মৃত্যুদণ্ডের আদেশে বিচলিত হননি মাত্র উনপঞ্চাশে পা দেওয়া এডিথ। জার্মান সেনাবাহিনী যেদিন তাঁকে গুলি করে হত্যা করে তার আগের দিন রাত্রে খ্রিস্টীয় মতে ফাদারের কাছে নিজের শেষ বয়ান দিয়েছিলেন তিনি। লন্ডনের সেন্ট মারতিনে স্থাপিত এডিথের স্ট্যাচুতে তাঁর উজ্জ্বল উক্তি খোদিত আছে ‘Patriotism is not enough, I must have no hatred or bitterness towards anyone.’ জীবনানন্দ তাঁর দুটি কবিতায় এডিথের নাম উল্লেখ করেছেন দেখে মনে হয় এডিথ নামে কোন বিশেষ ব্যক্তি থাকাই স্বাভাবিক। ‘কি ওয়ার্ড’ হিসেবে দুবার তিনি নার্স শব্দটা উল্লেখ করেছেন। ফলে এডিথ ক্যাভেলকে খুঁজে পেতে দেরী হয়নি। জীবনানন্দ যেন মনে করিয়ে দিতে চান মুমূর্ষুর সেবার জন্য রক্ত ঘা পুঁজ মল মূত্রের প্রতি বিবমিষা কাটিয়ে ওঠাই যথেষ্ট নয়, এডিথের মত অন্য যে কোন মানুষের প্রতিও ঘৃণা ও তিক্ততা কাটিয়ে ওঠা জরুরী। আমরা যেন আমাদের সহনাগরিকদের প্রতি ঘৃণা ও তিক্ততা কাটিয়ে উঠতে পারি— এডিথ বা মলিনা নাম্নী নার্সরা প্রতিদিন এইটুকুই তো শিখিয়ে চলেছেন আমাদের।

জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা / মনোকণিকা

চার্বাক প্রভৃতি—

‘কেউ দূরে নেপথ্যের থেকে, মনে হয়,
মানুষের বৈশিষ্ট্যের উত্থান-পতন
একটি পাখির জন্ম— কীচকের জন্মমৃত্যু সব
বিচারসাপেক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

‘তবু এই অনুভূতি আমাদের মর্ত্য জীবনের
কিংবা মরণের কোনো মূলসূত্র নয়।
তবুও শৃঙ্খলা ভালোবাসি ব’লে হেঁয়ালি ঘনালে
মৃত্তিকার অন্ধ সত্যে অবিশ্বাস হয়।’

ব’লে গেল বায়ুলোকে নাগার্জুন, কৌটিল্য, কপিল,
চার্বাক প্রভৃতি নিরীশ্বর;
অথবা তা এডিথ, মলিনা নাম্নী অগণন নার্সের ভাষা—
অবিরাম যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বায়ুর ভিতর।

Leave a comment

Website Built with WordPress.com.

Up ↑