শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গমহাপ্রভুর পঞ্চম দোল

DSC_0436 “আজ হোলি খেলব শ্যাম তোমার সনে
একলা পেয়েছি তোমায় নিধুবনে।
আজ হোলি খেলব, চরণে দলবো
কুমকুম মারিব তোমার রাঙা চরণে।”

খোল করতাল খঞ্জনী হারমোনিয়াম সম্বল। পঞ্চম দোলের ধূলটের দিন গান শুরু হল মহাপ্রভুর মন্দির প্রাঙ্গণে। এক ছন্দে সুরে মুখরিত হল গ্রামের ছোট বড় সকলেই। ঢাক ঢোল সানাই কাঁসি নিয়ে আগে আগে চলেছে বাদ্যকরের দল। পিছনে ছত্রধর। তাঁর পিছনে বড়দের দল। ঠাকুরবাড়ির দুইজনের হাতে হোলায় (বড় মালসা)  আছে আবির। সেই আবির সবাই মাথায় নিতে এগিয়ে আসছেন। কেউ মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে করছেন প্রণাম। শোভাযাত্রা বাড়ির সামনে এলে কেউ দিচ্ছেন খোলপ্রণামী। কেউ আবির নিয়ে প্রয়াত প্রিয়জনের ছবিতে দিচ্ছেন। তাদেরই পিছু পিছু যুবকদের দলটিও চলেছে গ্রাম পরিক্রমায়। রাস্তায় রাস্তায় সদর দুয়ারে মোড়ের মাথায় সবাই অপেক্ষায়। আবিরে রাঙিয়ে দিচ্ছে একে অপরকে। গ্রামের মাঝখানে এসে একটু জিরিয়ে নিল দুটি দল। কেউ জল বাতাসা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কেউ বা চা নিয়ে। গানের দল একটানা গেয়ে ক্লান্ত। চা মিষ্টি ভাগ করে নিল সবাই। মিনিট দশেক মাত্র। পুকুরের পাড় দিয়ে, বাঁশতলা পেরিয়ে এগিয়ে চলল দল।

DSC_0363

“ফাল্গুনপূর্ণিমা তিথি নক্ষত্র ফাল্গুনী।
জনম লভিল গোরা গৌরগুণমণি।।”
মহাপ্রভুর জন্মদিনে গৌরপূর্ণিমা উপলক্ষে বাংলায় ফাগুররঙ খেলার প্রচলন হয়। ফাল্গুনপূর্ণিমা তিথিতেই শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় প্রায় সারা ভারতে। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, “দোলযাত্রা। যাত্রা শব্দের অর্থ গমন। পরে অর্থ আসিয়াছে, দেবতার উৎসব। যে দেবতা গমন করেন, বহু লোক তাঁহার অনুগমন করে, তখন বলি যাত্রা। যেমন, জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা। দুর্গাপূজার সময় দুর্গা গমন করেন না, দুর্গাযাত্রা বলিতে পারি না। দোল, দোলন। … দোলযাত্রা একটি নয়, বৎসরে দুইটি। একটির নাম দোল, অপরটির নাম হিন্দোল, চলিত নাম ঝুলনযাত্রা। সূর্যরূপ বিষ্ণু বৎসরে দুইবার দোলায় আরোহণ করেন।” দোলযাত্রার তিনদিন পর বীরভূমের নানুর থানার বড়া সাওতা গ্রাম পঞ্ছায়েতের বড়া গ্রামে পঞ্চমীর ভোরে চাঁচর পুড়িয়ে শুরু হয় পঞ্চমদোল। পঞ্চমীতে বিগ্রহের গ্রাম পরিক্রমা, দুপুর থেকে কীর্তন গান চলে। সন্ধ্যায় কীর্তন ও দোলগান হয়ে রাতে ক্রমান্বয়ে দুবার আবির খেলা হয়।  ষষ্ঠীর দিন দুপুরে অন্নকূট ও বিকেলে ধূলট হয়ে শেষ হয় উৎসব। কেন পঞ্চম দোল? – শাস্ত্রমতে পঞ্চম কথাটির মধ্যে অনেক তত্ত্ব লুকিয়ে আছে। ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষকে ছাড়িয়ে পঞ্চম পুরুষার্থ প্রেমকে স্বীকৃতি দেন মহাপ্রভু, কারণ প্রেমই শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্যের আস্বাদন করায়।

“ভক্ত ভেদে রতি ভেদ পঞ্চ পরকার ।
শাস্ত রতি দাস্য রতি সখ্য রতি আর ॥
বাৎসল্য রতি মধুর রতি এ পঞ্চ বিভেদ।
রতিভেদে কৃষ্ণভক্তি রস পঞ্চ ভেদ ॥
শান্ত দাস্য সখ্য বাৎসল্য মধুর রস নাম ।
কৃষ্ণ ভক্তি রস মধ্যে এ পঞ্চ প্রধান ॥”

পঞ্চমীর সন্ধ্যায় আটনে শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গমহাপ্রভু

শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর –প্রেমভক্তির পঞ্চম রস মধুর রসেই পাঁচটি গুণ পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ পায়। দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের সময় গোদাবরী তীরে পার্ষদ রায়রামানন্দের সঙ্গে কথোপকথনে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গমহাপ্রভু।
“প্রভু কহে কহ মোরে সাধ্যের নির্ণয়।
রায় কহে স্বধৰ্ম্মাচরণে কৃষ্ণভক্তি হয়৷
এহ বাহ্য প্রভু কহে আগে কহ আর॥
রায় কহে কৃষ্ণে কৰ্ম্মাপণ সৰ্ব্বসার।
প্রভু কহে এহ বাহ্য আগে কহ আর॥
রায় কহে স্বধৰ্ম্মত্যাগ সৰ্ব্বসাধ্যসার।
প্রভু কহে এহ বাহ্য আগে কহ আর॥
রায় কহে জ্ঞানমিশ্র ভক্তি সাধ্যসার।
প্রভু কহে এহ বাহ‍্য আগে কহ আর॥
রায় কহে জ্ঞান সুপ্ত ভক্তি সাধ্যসার।
প্রভু কহে এহ বাহ‍্য আগে কহ আর॥
রায় কহে প্রেম-ভক্তি সৰ্ব্বসাধ্যসার।
প্রভু কহে এহ বাহ‍্য আগে কহ আর॥
রায় কহে দাস্য-প্রেম সৰ্ব্বসাধ্যসার৷
প্রভু কহে এহোত্তম আগে কহ আর॥
রায় কহে সখ্য-প্রেম সৰ্ব্বসাধ্যসার।
প্রভু কহে এহোত্তম কিছু আগে আর॥
রায় কহে বাৎসল্য-প্রেম সর্ব্বসাধ্যসার।
প্রভু কহে এহোত্তম আগে কহ আর ॥
রায় কহে কান্ত-প্রেম সব্ব সাধ্য সার।
প্রভু কহে এই সাধ্যাবধি মুনিশ্চয়।
কৃপাকরি কহ যদি আগে কিছু হয়।
রায় কহে রাধা-প্রেম সাধ্যশিরোমণি ।
যাহার মহিমা সৰ্ব্ব শাস্ত্রেতে বাখানি ॥” —শ্ৰীচৈতন্যচরিতামৃত
বাংলার ইতিহাসের একটি অধ্যায় জড়িয়ে আছে বড়ার মহাপ্রভু মন্দিরকে ঘিরে। ১৭৪২ এ আলীবর্দী খাঁ যখন উড়িষ্যা অভিযানে ব্যস্ত, তখন মারাঠা দস্যু ভাস্কর পণ্ডিত বাংলা আক্রমণ করেন। বর্ধমান লুঠ করতে করতে তিনি কাটোয়া দখল করে নেন।  অন্নদামঙ্গলে ভারতচন্দ্র লিখছেন,

বর্গি মহারাষ্ট্র আর সৌরাষ্ট্র প্রভৃতি।

আইল বিস্তর সৈন্য আকৃতিবিকৃতি।।

লুটি বাঙ্গালার লোকে করিল কাঙ্গাল।

গঙ্গা পার হইল বান্ধি নৌকার জাঙ্গাল।।

কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি।

লুটিয়া লইল ধন ঝিউড়ী বহুড়ী।

পলাইয়া কোঠে গিয়া নবাব রহিল।

কি কহিব বাঙ্গালার যে দশা হইল।

বুকভোর মন্দিরের সামনে নাটমন্দির

পঞ্চমীর রাতে সপরিবারে সমবেত দোলগান

তখন শ্রীখণ্ড থেকে গৃহদেবতা মহাপ্রভুকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে ৬০ কিমি দূরে এই বড়া গ্রামেই আশ্রয় পান চট্টরাজ পরিবার। বর্তমানে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই বোলপুর কলকাতা উখড়ায় প্রবাসী। পরিবারের অন্যতম সদস্য গুরুপদ চট্টরাজ জানালেন, “আমার  পিতৃদেব ঈশ্বর কৃপাসিন্ধু চট্টোপাধ্যায় যা বলেছেন বলছি। বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাছে মৌগ্রাম, সেখানের চট্টরাজ পরিবারের এই বিগ্রহের সেবা দিত। এমন একটা অবস্থা এল, বর্গি আক্রমণের সময়, তারা দেবদেবীর মূর্তি ভেঙ্গে দিচ্ছিল, নষ্ট করে দিচ্ছিল। তখন শ্রীমানবিগ্রহকে নিয়ে তারা যে একটা শান্তিপূর্ণ জায়গায় আসবে তা সম্ভব ছিল না। তখন ঐ মৌগ্রামের পাশে গঙ্গায় বিগ্রহকে বিসর্জন দিয়ে রাধাদামোদর নারায়ণশিলাকে পৈতায় বেঁধে রাস্তা হাঁটতে শুরু করেন। অনেক রাস্তা পেরিয়ে এসে এই বড়া গ্রামের ছআনা পাড়ায় তারা বিশ্রাম নিলেন। সেখানেই স্বপ্নাদেশ পান, যে ঠিক আছে আমায় তো বিসর্জন দিয়েছ, এই গ্রামের উত্তর দিকে একটি নিমগড়ে বলে পুকুর আছে আর একটি নিমগাছ আছে। সেই নিমগাছের কাঠ থেকে আমার দারুবিগ্রহ অর্থাৎ কাঠের বিগ্রহ তৈরি কর। যে মিস্ত্রি তৈরি করবে সে এই গ্রামেরই পূর্বদিকে বসবাস করে সূত্রধর পরিবারে। তাকেও আমি স্বপ্ন দিয়েছি। সেও তোমাদের বলবে। আমার বিগ্রহ কেমন হবে তার ছবি আমি তার মনের মধ্যে দিয়েছি। সে ঠিক তৈরি করতে পারবে। সকালেই সেই সূত্রধর এসে খোঁজ করল এখানে কোন ঠাকুরমহাশয় এসেছেন? সবাইমিলে যাওয়া হল নিমগড়ে পুকুরপাড়ে, দেখা গেল একটাই গাছ আছে। সেটি হল নিমগাছ। সেই গাছ কেটে একটি খণ্ড দিয়ে এই বিগ্রহ তৈরি হয়। যখন অঙ্গরাগ হয় তখন আমি নিজে দেখেছি, তার উপর সামান্য গঙ্গামৃত্তিকার প্রলেপ আছে। সেই থেকে বিগ্রহ সেবিত হতে শুরু করল। আর এই চট্টরাজরাই সেবক। সনারন্দির রাজার বনহরিবাদের সভাপণ্ডিত ছিলেন কৃষ্ণহরি চট্টরাজ। রাজবাড়িতে দোল উৎসবের কারণে তিনি ব্যাস্ত থাকতেন। তাই সুবিধেমত  নিজের বাড়িতে পঞ্চমদোলের প্রচলন করেন তিনি। চৈতন্যমহাপ্রভু অপ্রকট হওয়ার পর লেখা হয় শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত।
যেবা নাহি বুঝে কেহ,          শুনিতে শুনিতে সেহ,
কি অদ্ভুত চৈতন্যচরিত।
কৃষ্ণে উপজিবে প্রীতি           জানিবে রসের রীতি,
শুনিলেই বড় হয় হিত ।।
আমাদের পরিবারের আশ্রয় শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত।  আর এই মহাপ্রভুর দোল।”

DSC_0394

একসময় এই পঞ্চমদোল ছিল গ্রামের সবচেয়ে বড় উৎসব। আড়াইশ বছর হয়ে গেল, আজও নাটমন্দির থেকেই বিগ্রহদর্শন করতে হয় ভক্তদের। পারিবারিক মন্দির হওয়ায় মহাপ্রভুর মূল মন্দিরের বুকভোর দাওয়ায় ওঠার অনুমতি নেই সর্বসাধারণের। প্রণামী হিসেবে ভক্তদের দান নেওয়া হলেও উৎসবে সর্বসাধারণের আর্থিক সাহায্য নেওয়া হয় না। সেই কারণেই গ্রামের কালীপূজা জাঁক জমকে আজ পঞ্চমদোলকে ছাপিয়ে গেছে। তবে উৎসাহ উদ্দীপনার কম কিছু দেখিনা আবির খেলায়। ধূলটের আগে গ্রাম পরিক্রমায় ঢল নামে মানুষের।
“যত ব্রজনারী, মারে পিচকারী।
তাদের কাঁখেতে কলসি রহে না গো,
সখী যমুনায় জল আনিতে আর যাব না গো।”

মধুরেন

সন্ধ্যে নেমেছে। পেট্রোম্যাক্সের আলোয় এগিয়ে চলেছে গানের দল। বাবাজীর আখড়ায় সমাধিতে রঙ দিতে ভুলল না এক ভক্ত। গানের দলের এক ঢুলিদারের গাল খালি দেখে তাকে রাঙিয়ে দিল এক যুবতী। টিউশন পড়তে এসেছিল পাশের গ্রামের বন্ধু। তাকে কাছেটেনে আবিরে রাঙিয়ে দিল স্কুলের বান্ধবীরা। গ্রাম পরিক্রমা শেষ হয়ে এল। অন্ধকারে কত ছাত্র ছাত্রী এসে আবির দিয়ে গেল গালে পায়ে মাথায়। ছাত্রীছাত্রদের মুখ চেনা দায়। একজন ফিসফিস করে বলে গেল, ‘স্যার বাঁদুরে রঙ হইতে সাবধান।’ সে কীরে!  ভাবতে ভাবতেই ধূলট শুরু হয়ে গেল। বড়দের দল ছুটে এল মন্দিরের দিকে। পিছনে এল ছোকরাদের দল। আরও তিনটে দল এল পেছনে পেছনে। তুবড়ি জ্বলে উঠল। আলোয় ভরে গেল গানের দলের রঙিন মুখগুলো। মুখে তাদের একটাই আওয়াজ,

“ছি ছি ছি হারুয়া নাগর।
ছি ছি ছি হারুয়া নাগর।
ছি ছি ছি হারুয়া নাগর।”

রঙের খেলায় কৃষ্ণ পরাজিত হয়েছেন রাধার সখীদের কাছে। সবাই তাই নাগরের নামে দুয়ো দিচ্ছে। কৃষ্ণ মুখ লুকিয়েছেন লজ্জায়।
মন্দিরের এক কোণে জায়গা দখল করলুম। দৌড়তে দৌড়তে সাতবার মন্দির পরিক্রমার পর শুরু হল হরিলুঠ। কিলো কিলো বাতাসা উড়তে থাকল বাতাসে। কেউ আঁচল পাতল, কেউ কুড়িয়ে তুলল ধুলো থেকে। শেষ হল পঞ্চম দোল। নতুন যুগের ছেলেরা বক্স ভাড়া করেছে। একটা গাড়িতে তাদের শব্দযন্ত্রগুলি বাংলা হিন্দি গানে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল গ্রাম। বছর দুই হল এটিও সংযোজিত হয়েছে লেজুর হিসেবে। মেলার ভিতরে তারা আসেনি এই রক্ষে। এতদিন ঠাকুরবাড়ি থেকেই আয়োজন করা হত যাত্রাপালার। এইবছর যাত্রা বন্ধ করে চালু হয়েছে লোকগীতির আসর। আগামী কাল ভোরে চাঁচর পুড়িয়ে মুখার্জীদের বাড়িতে শুরু হবে অষ্টম দোল।


ক্ষেত্র সমীক্ষার গ্রামঃ বড়া, নানুর, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ
ঋণ স্বীকারঃ চট্টরাজ পরিবারের সকল সদস্য, পুলক পাল, সোহম মিত্র, বেদাভ মিত্র, স্মৃতিকণা মিত্র, বড়া গ্রামবাসীবৃন্দ বড়া, নানুর, বীরভূম

 

আবিরে রাঙাল ২আবিরে রাঙাল ১

DSC_0430

Leave a comment

Website Built with WordPress.com.

Up ↑