কান ধরা ছবি, ‘সরি স্যার’-প্রতিবাদের অচেনা ভাষা

“ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়।
দোসর জনম দিলা তিহ সে আহ্মার।।“
        ইউসুফ জোলেখা; শাহ মুহম্মদ সগীর ; চতুর্দশ শতক
FB_20160518_18_19_40_Saved_Picture.jpgকান ধরে ছবি, সঙ্গে লেখা ‘সরি স্যার’- এত বড় সাহসী ছবি দেখিনি

ইতিমধ্যেই প্রচার শুরু হয়ে গেছে। গোয়েবেলসীয় প্রচার পদ্ধতি (হিটলারের প্রচারমন্ত্রী যোসেফ গোয়েবলস) প্রমাণ করে দেবে শিক্ষক মহাশয় শ্যামলকান্তি ভক্ত দোষী ছিলেন, তিনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছিলেন। শুধু বাংলাদেশ কেন, এদেশেও এমন প্রচার পদ্ধতি কাজ করে। কিন্তু লিখতে বসলাম সম্পূর্ণ অন্য কারণে।

শ্যামলকান্তি স্যারের প্রতি হওয়া অন্যায়ের নিন্দা করে প্রচুর ছবি পোস্ট হয়েছে সোশ্যাল সাইটে। নিজের কান ধরে ছবি, সঙ্গে লেখা ‘সরি স্যার’। বন্ধুরা অনেকেই বলছেন

১। এই কান ধরে ছবি পোস্ট করাটা এক ধরণের ন্যাকামো।

২। চটকদার এক প্রচারে মেতেছে এরা ফেসবুকে।

৩। কিছুই হবেনা এমন আন্দোলন করে।

প্রতিবাদের অচেনা ভাষা মানুষের বুঝতে দেরী হয়। পরে কালে কালে বহু ব্যবহারে জীর্ণ সেই ভাষাকেই একদিন ক্লিশে লাগে। তখন নতুন ভাষা খুঁজে বের না করলে নতুন যুগের মানুষকে নাড়ানো যায় না। এইকারনেই শ্রীচৈতন্যের নৃত্যের ভাষাকে ব্রাহ্মণরা পাগলামি বলেছে, রবীন্দ্রনাথের রাখীবন্ধনকে পরাধীন দেশের মানুষ  ভেবেছেন ছেলেমানুষি; সেলুলার জেলে অনশনের সমর্থনে বা গান্ধীর সমর্থনে( এবছর সত্যাগ্রহের একশবছর ) ‘অরন্ধন’ পালিত হলে, আদালতে বম ফাটিয়ে পালিয়ে না গিয়ে ধরা দিলে– সে ভাষা পড়তে পারেননি অনেকে। এইসব ভাষা পড়তে না পারাই স্বাভাবিক। পড়তে এবং বুঝতে দেরী হয় বলেই হ্যাপি টু ব্লিড, হোককলরব ইত্যাদি প্রতিবাদের প্রতি বেঁকা দৃষ্টি হানে সমাজ। কারণ মানুষ যে সমাজ কাঠামোয় বন্দী সেখানে ইতিমধ্যেই একটি ভাষা নির্মিত হয়ে আছে।

এই সহজ সত্যটা সাম্প্রতিক কালে আরও একবার প্রমাণ করল বাংলাদেশের মানুষরা। সহজ সত্যটা এই যে একটা বড় মেসেজ অনেকের কাছে খুব দ্রুত পৌঁছে দিতে এমন অহিংস সত্যাগ্রহের বিকল্প নেই। কাউকে পিছন থেকে চাপাতির ঘায়ে নিস্তব্ধ করেনি, বম মেরে উড়িয়ে দেয়নি প্রসাশনের গাড়ি বা মিছিলে স্তব্ধ করেনি শহরকে। ‘সরি স্যার’ লিখে কান ধরা অবস্থায় একটি  নিতান্তই সাধারণ ছবি পোস্ট করেছে । একা কিংবা কয়েকজন মিলে। হ্যাঁ, মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক শ্যামলবাবুকে  হেনস্থার প্রতিবাদে এমনই ভাষায় কথা বলেছেন বাংলাদেশের বন্ধুরা। আর একদিনেই তা ধাক্কা দিয়েছে সমাজকে। ব্যাপারটা বুঝে উঠেই পাল্টা আঘাত হেনেছেন অনেকে।”আমরা যে কত আবাল আর হুজুগে জাতিতে পরিনত হচ্ছি,তার একটি প্রমান উপরের ছবিগুলো। নারায়ণগঞ্জের কল্যান্দি এলাকার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে শ্রেণীকক্ষে মন্তব্য করেছেন,এই অভিযোগে স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের নির্দেশনায় কান ধরে উঠ-বস করানো হয়েছে।আর এই প্রতিবাদে কিছু আবাল ও হুজুগে পাবলিক নিজের কান ধরে এর প্রতিবাদ করে ফেসবুকে ছবি আপলোড করছে । এর আসলে কোনো মানেই খুজে পাওয়া যায় না।যদি তাদের গাটস থাকতো তাহলে তাদের উচিত ছিলো,সেলিম ওসমানের বাড়ী বা কার্যালয় শান্তিপুর্নভাবে ঘেরাও করে,তাকে নিজের কান ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা।”কেউ ব্যাঙ্গ করেছে “আমরা একে-একে কান-ধরা-ছবি ফেসবুকে সাঁটিয়ে মেরুদণ্ডী হয়ে উঠছি।’

এপার থেকে একই রকম ছবি পোস্ট করে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেছেন। এই যে সহজে এই বার্তাটা এদেশে পৌঁছে দেওয়া গেল, এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের হেনস্থায় আমরা এপারের অনেকেই লজ্জিত, এটা কম কথা নয়।   বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বিতারন ও সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচার নতুন কথা নয়। এবং তার প্রতিবাদে বাংলাদেশে অনেক মিটিং মিছিল হয়। অথচ সেসব প্রকাশ্যে আসেনা। উত্তরপ্রদেশ কাণ্ডের পর, মহারাষ্ট্র কাণ্ডের  প্রতিবাদে ভারতেও যে প্রতিবাদ হয় তা বাংলাদেশের অনেক মানুষ আজও জানতে পারতেন না যদিনা প্রকাশ্যে গো মাংস খেয়ে তার ছবি পোস্ট হত ফেসবুকে। অর্থাৎ আপনার প্রতি হওয়া অন্যায়ের জন্য আমি  লজ্জিত, ব্যথিত। হ্যাঁ, চুমু খাওয়া, ব্রা পরে মিছিলে হাঁটা, ন্যাপকিন সাঁটানো, কান ধরা, কাগজ পোড়ান, অনশন করা, কুশপুত্তলিকা পোড়ান এসব  চটকদার মনে হয়। চটকদার লাগে অনেকের কাছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই সব ভাষা ভীষণ ভাবেই অহিংস সত্যাগ্রহে বিশ্বাসী। নিজের দেহকে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিবাদের জন্য। হাতিয়ার আমার শরীরই । রাষ্ট্রকে শুধু নয়, আমাকে আপনাকেও বিব্রত করতে পারছে তারা। আর কি চাই? ওরা গাইছে, ছবি আঁকছে, না খেয়ে শুয়ে আছে। এক্ষেত্রে আরও নিরীহ মনে হচ্ছে  আজকের ভাষাটা?

কিছুই করেনি। শুধু কান ধরে ছবি পোস্ট করেছে। আমার মোটেই নিরীহ লাগেনি ছবিগুলো। ওদের সাহস দেখে চমকে উঠেছি। কেউ হাঁটু গেড়ে কান ধরে বসে আছে, কেউ বা শির ঝুঁকিয়ে কান ধরে আছে, কেউবা বোরখা না পরেই কান ধরে তাকিয়ে আছে সামনে, কেউবা অনেকের সাথে কান ধরে সারবদ্ধ দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। আর তার সঙ্গে লেখা ‘সরি স্যার’। এত বড় একটা স্টেটমেন্ট বাংলাদেশের কয়েকজন মানুষ দিয়ে ফেলেছে যে তাতেই নড়ে চড়ে গেছে প্রশাসন। কেন এত বড় স্টেটমেন্ট? কেন বলছি এত বড় সাহসী ছবি দেখিনি ইদানিং কালে? চরম কট্টরপন্থী  যে দল্গুলি বাংলাদেশে সক্রিয়, যারা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠা করেছেন চাপাতির সংস্কৃতি, তারা ‘মুরতাদ’ বা ‘কাফের’ বলে হত্যা করেছে অভিজিত, বাবু, অনন্ত, নিলাদ্রিকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকিকে এই সেদিন কুপিয়ে হত্যা করা হল। হত্যকারিরা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে ‘আল্লাহ্‌ ছাড়া মানার উপযুক্ত কেউ নেই। আমরা একমাত্র আল্লাহর গোলামী করব।” বলেই তারা সমন্বয় সাধনার ধারাগুলিকে আক্রমণ করছেন। পীর বাবা, জনক, ঘোষক, ফুরফুরা, দেওয়ান বাগী এসব মানতে নিষেধ করা হচ্ছে। আক্রমণ করছেন হিন্দু বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মগুলিকে। নাস্তিক হলে তো কথাই নেই।  বাংলাদেশে কট্টরপন্থীদের একটাই কথা ‘আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করিনা, আল্লাহ্‌ ছাড়া কারো কাছে ক্ষমাও চাইব না’ – ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’  এর তারা অর্থ করছেন  “আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কারো কথা মানা যাবেনা। অর্থাৎ বাবা-মায়ের কথা মানা যাবেনা, নেতার কথা মানা যাবেনা, শাসকের কথা মানা যাবেনা, totally কারো কথা মানা যাবে না। এমন কি নিজের কথাও মানা যাবে না।”

এই অবস্থায় একদল ছাত্র ছাত্রী সাধারণ মানুষ মাথা নত করল ‘শিক্ষক’ এই পরিচিত ‘শব্দ ও চেতনা’র কাছে! ক্ষমা চাইল শিক্ষকের কাছে! আল্লাহর কাছে নয়! প্রথম ছবিগুলো দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ওদের সাহস দেখে। যেখানে অভিজিতের বই ছাপানোর কারণে প্রকাশক  দীপনকে হত্যা করা হয়, হিন্দু দর্জি নিখিল  চন্দ্র জোয়ারদারকে  হত্যা  করা হয় ইসলাম অবমাননার কারণে, এইতো ১৩ তারিখ হত্যা করা হল বৌদ্ধ সন্যাসীকে– সেখানে যে অচিরেই এই কান ধরা ছেলেমেয়েগুলোর কেউ কেউ খুন হয়ে যাবে এই ভেবে শিউরে উঠলাম। এমন নিরীহ ছবি চাবুক মেরেছে কট্টরপন্থীর গায়ে। তোমরা দেখে নাও আমরা আল্লাহ্‌ ছাড়াও কারো কারো সামনে নত হই। আল্লাহ্‌ ছাড়াও কারো কারো কাছে ক্ষমা চাই আমরা, তোমরা দেখে যাও। যাদের কাছে নত হই, যাদের কাছে ক্ষমা চাই  তাদের একজন হলেন শিক্ষক। কারণ, পিতার চেয়েও বড় হলেন ওস্তাদ বা শিক্ষাগুরু। কারণ তাঁর কাছেই আমার দ্বিতীয় বার জন্ম হয়েছে। তাঁকে প্রণাম করি। আজ তাঁর অপমানে আমরা লজ্জিত। কান ধরে তাঁর সামনে নত হয়ে বলছি “স্যার ক্ষমা করবেন।”

পুনশ্চ – চতুর্দশ শতকের কবি শাহ্‌ মুহম্মদ সগীর ৬০০ বছর আগে গৌড়বঙ্গের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের (১৩৯৩-১৪০৯) আমলে লিখেছিলেন প্রণয়কাব্য ‘ইউসুফ জোলেখা’। সেই মধ্যযুগের রীতি মেনে তিনি গ্রন্থের শুরুতে আল্লাহ ও রসুলের  বন্দনা করেন, তারপর বাবা মা এবং গুরু বা শিক্ষকের বন্দনা করেন। তারপরে করেন  সুধিজনদের বন্দনা । এই অপরাধে তাঁর মাথা কাটা হয়নি ।

Leave a comment

Website Built with WordPress.com.

Up ↑