নস্টালজিয়া ১ – টিভি

old-indian-TV-brand

রাকেশ শর্মার মহাকাশ অভিযান বা অপারেশন ব্লু স্টারের জন্য নয়, ইন্দিরা গান্ধী হত্যা কিংবা ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনার জন্যও নয় – ১৯৮৪ সালকে একটি ঘটনার জন্যই আমাদের গ্রামের মানুষ এখনও মনে রেখেছে – তখন ভারতে প্রতিবছর গড়ে যে ৩০ লক্ষ টিভি সেট বিক্রি হত তারই একটি বনবাদাড় ঠেঙিয়ে ‘রায় বাড়ি’তে এসে পৌঁছয়। এবং রাতারাতি এলাকায় শিরোনামে চলে আসে গ্রামটি। একটি সাদাকালো ‘কেলট্রন টিভি’ বিনোদন ও স্ট্যাটাস সিম্বলের সূচক হয়ে দাঁড়ায়। রেডিও ক্রমশ তার আভিজাত্য হারাতে থাকে গোটা আশির দশক ধরে।

বড় হতে থাকি। রেডিওতে গান বাজে, বাবা ডুবে যান কাজে – আর বাড়ির সবকটা বাচ্চাকে নিয়ে পড়তে বসে মা। একদিন, প্রতিদিন। শুধু বুধ আর শুক্রবার সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি ছুটি। পড়া শেষ; রান্নাও শেষ সাড়ে সাতটায়। তারপর ‘কলকাতা ক’ কেন্দ্র থেকে শুরু হত ‘আজকের নাটক’। – অসম লড়াইতে মা ক্রমশ একপেশে হয়ে পড়ল। বস্তুতই ‘বিবিধ ভারতী’ ‘কলকাতা ক’ ‘কৃষি কথার আসর’ ‘গল্প দাদুর আসর’ ‘বিজ্ঞাপনদাতা আয়োজিত অনুষ্ঠান’ ‘স্থানীয় সংবাদ’ আর ধরে রাখতে পারছিল না তার ছোট্ট শ্রোতাদের।

ধান উঠে গেলে ক্লাবের ছেলেরা পর্দা খাটিয়ে সিনেমা দেখায় – তেমনই ঐ বাক্সটার ভিতরে মানুষ নড়ে চড়ে কথা বলে। কারেন্ট চলে গেলে আমাদের ছবি দেখা যায় ওর ভিতরে। মাঝে মাঝে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ে শো শো শব্দে। তখন স্বপন কাকু এন্টেনার বাঁশটাকে এদিক ওদিক ঘোরায়, আমরা ‘ছবি এসেগেছে’ বলে চিৎকার করে উঠি। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ভোরের রেডিওর মত আওয়াজ হয়, কানে ঝি ঝি পোকা ডাকে। এই বাক্সের কাছে মায়ের গল্প বলা, মঙ্গল চণ্ডীর ব্রত কথা, রেডিও নাটক, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের যাত্রাপালা সব ম্লান হয়ে যায়। এবার আমাদের আবদার শুরু হয়, ‘টিভি দেখতে যাব’। মায়ের ‘না’ শুনে কান্না চেপে আসে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়ে মা তার নিয়মের রাজত্বে আমাদের বন্দি করে রাখে। একে একে হালদার বাড়ি, চক্রবর্তী বাড়ি, ঘোষ বাড়ি, সাঁতরা বাড়িতে টিভি এসে একা একটা ঘর দখল করে নেয়। আর শুরু হয় আমাদের চোর পুলিশ খেলা। পুকুরের ঘাটে, শিবতলায়, দোকানে গিয়ে ছেলেদের লুকোচুরির কথা জানতে পেরে মাও সামলাতে পারেনা নিজেকে, মারতে মারতে বলে ‘বলেছি না ওদের বাড়িতে টিভি দেখতে গিয়ে বিছানায় উঠবি না।’ – চোখের জলে ভিজে যায় অঙ্কের খাতা, বুঝতে পারি মায়ের চোখ এড়িয়ে এই পৃথিবীর কোথাও যাওয়া যাবেনা, ‘আর যাবনা’ শপথ নিয়েও তবু লোকের বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাড়াই, চেনা বন্ধুরা ডাকলে গিয়ে বসি ভিতরে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি টিভির দিকে।

ক্লাস ওয়ানে প্রথম সরাসরি অনুমতি মিলল। মা নিজেই বলল রবিবার সকালে সবাই “রামায়ণ” দেখতে যেতে পারবে। আশ্চর্য হলেও সত্যি মা কাকিমা ঠাকুমারা এই প্রলোভন থেকে দূরে সরিয়ে রাখলেন, রাখতে বাধ্য হলেন। বাড়ির বউয়েরা পরের বাড়ির উঠোনে বসে টিভি দেখবে এটা বাড়ির পুরুষদের পক্ষে সম্মানের সঙ্গে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল তখন। ‘রামায়ণ’এর চেয়েও বড় ছিল নিশ্চয়ই বাড়ির আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। কখনও কখনও মা-কাকিমা আমাদের পৌঁছে দিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে যেত; কিন্তু বিজ্ঞাপনের বিরতিতেই কাজের অজুহাত দেখিয়ে মহাকাব্যের প্রলোভন এড়িয়ে ঘোমটা টেনে হাঁটা দিত বাড়ির পথে।

সে এক দেখার মত দৃশ্য বটে। দুলে, সাঁওতাল, কুলি, বাগদী, মুচি, মেথর, ব্রাহ্মণ, সদগোপ, চাষা, রাজমিস্ত্রি, মাস্টারমশাই, ছাত্র, ভিখিরি কে নেই! সব গা ঘেঁসে বসে রয়েছে রায় বাড়ির উঠোনে, হালদার বাড়ির বারান্দায়। ঠাকুর মশাইকে মোড়া দেওয়া হয়েছে আলাদা করে। মাস্টার মশাই সকাল থেকে কিছু খাননি শুনে মুড়ি মেখে দিল বামুনের মা। টিভিতে ফুটে উঠলেন রামানন্দ সাগর, আর সেই ক্ষণে আবাল বৃদ্ধ বনিতা মাথায় হাত ঠেকিয়ে সমস্বরে বলে উঠল ‘জয় শ্রী রাম’। মাঝখানে সপ্তাহ খানেক সম্প্রচার বন্ধ ছিল। যেন কি একটা ঝড় বয়ে গেছে সংসারের উপর দিয়ে। কোন দূর গ্রামে কাদের ছেলে হনুমান সেজে ছাদ থেকে লাফ দিল – কেউ মরল, কেউবা বেঁচে গেল সে যাত্রায়। দাদু আরও একটা বিড়ি ধরিয়ে সুখ টান দিয়ে বলল ‘দেশটা উচ্ছন্নে গেল।’ আর দাদুর নাতি নাতনিরা মায়েদের হাত ছাড়িয়ে চলে গেল ‘মহাভারত’ দর্শনে। ততদিনে গ্রামে টিভির সংখ্যা ১১টি। ভিড়ের ঠেলায় সবাইকেই উঠোনে টিভি নামিয়ে দিতে হয়।

এক ঋষি শঙ্খ ধ্বনি করেন, আর গ্রহ নক্ষত্র ঘুরতে শুরু করে। এক জলদগম্ভীর স্বর বলে ওঠে, ‘ম্যায় সময় হু…’ – সেই চুরানব্বই এপিসোড ‘রামায়ণে’র জনপ্রিয়তাকেও ম্লান করে দেয়। ‘মহাভারত’ শুরু হলেই জনশূন্য রাক্ষসপুরী হয়ে যায় দেশ। বন্ধুরা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে উঠি। কাকা তীর ধনুক বানিয়ে দেয়। ঘোষেদের আমবাগানে, বটতলায় ধানের গাদার আড়ালে আড়ালে পাণ্ডবপক্ষ কৌরবপক্ষ সেনা সাজায়। “তারপর দ্রোণ তো একেবারে দশবাণ ছুঁড়লেন, অর্জুন করলেন কি, একেবারে দুশোটা বাণ দিলেন মেরে। তারপর – ওঃ – সে কি যুদ্ধ! বাণের চোটে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল।”

সকাল আটটায় অফিস বেরিয়ে রাত আটটায় বাড়ি ফেরাই ছিল বাবার সারা সপ্তাহের রুটিন। সন্ধ্যেয় ঘুমে চোখ বুজে আসতে না আসতেই শুনতে পেতুম সাইকেলের ঘণ্টি, কিরিং কিরিং। দাদা এগিয়ে গিয়ে সাইকেলটা ধরত, মা ব্যাগটা নিত। আমি নড়ে চড়ে বসে জোরে জোরে পড়তাম, “আজ খুব শীত। কচুপাতা থেকে টুপ টুপ ক’রে হিম পড়ে। ঘাস ভিজে। পা ভিজে যায় । দুখী বুড়ি উনুন- ধারে ব’সে আগুন পোহায় আর গুন গুন গান গায়।”

প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজনের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে মা-বাবা দুজনেই টিভি (বোকা বাক্স ?) দর্শনের সুখটুকু তাদের পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের অহংকারেই দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন প্রায় দুই দশক। দাদা এমএ পাশ করল। আমি মাধ্যমিক পাশ করলুম। তারপর ১৯৯৮ সালে আমাদের বাড়িতে টিভি এল। সাদাকালো না, একেবারে রঙিন। না এনে উপায় ছিল না। হরিনাম শুনতে যাওয়ার নাম করে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে রাতের হিন্দি ছবি ‘রূপ কি রানি চোরও কি রাজা’র শো দেখতে যাচ্ছি ক্লাস নাইনেই, মামার বাড়িতে একা একা রাত জেগে ‘বেতাব’ এইভাবেই দেখা। বাড়ির টেপরেকর্ডারে বাজাই ‘দিলঅয়ালে’ ছবির গান। এ পাড়ায় ও পাড়ায় হোল নাইট ভিডিও শো দেখছি আর ভক্ত হয়ে উঠছি আমির খান অজয় দেবগণের। দাদার হয়েছে মহা বিপদ, বিশ্বকাপ ফুটবল কড়া নাড়ছে দরজায়। আগের বিশ্বকাপ না হয় কলেজ হোস্টেলে দেখেছে, এবার? রোনাল্ডো খেলবে আর আমরা রেডিও শুনব? মা বাবা হার মানলেন। আমাদের দুই ভাইয়ের জিদের জয় হল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পাড়ার লোকে। যাক, হারু ঘোষ ছেলেদের কাছে হার মেনেছে। আসলে টিভি ততদিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য হিসেবে এতটাই প্রয়োজনীয় উঠেছে যে ওকে রোজ না দেখে বাঁচা যায় না। তবে সেই একদশক আগের মায়াঅঞ্জন ততদিনে তার কপালে গালে লেপটে যেতে শুরু করেছিল। আর আমার যৌবনেই সে হয়ে গেল উন্মাদিনী বিনোদিনী দাসী। কেবল কানেকশন গ্রামে আসে ২০০২ এ।

এখনও মা বাবা নিয়মিত রেডিও শোনেন। এখনও শব্দ ছক মিলিয়ে খাওয়া দাওয়ার শেষে একটু বই পড়তে বসে যান। সঙ্গে যোগ হয়েছে সন্ধ্যের সিরিয়াল টুকু। ‘সাহিত্যের সেরা সময়’ থেকে ‘ইষ্টিকুটুম’ কাউকেই বাদ দেয়না মা। এরমধ্যে আরও একটা সিরিয়াল দেখা হয় সপরিবারে। মা বাবা দেখে, বাড়ি ফিরলে আমিও দেখি, ‘মহাভারত’। হ্যাঁ ‘মহাভারত’! ‘মহাভারত’ দেখি এলসিডি টিভিতে। বাংলায় ডাবিং করা বি আর চোপড়ার ‘মহাভারত’ দেখায় একটা চ্যানেলে। দেখতে দেখতে মনে পড়ে দুই দশক আগের পাড়াগাঁর সেই রবিবারের সকালগুলো। দেখি আর ভাবি, দুই দশকে আমার চোখে কতোটা পালিশ পড়েছে! আমার ভালো লাগেনা তেমন। যে বিস্ময়ে আমার মা বাবা মহাভারত দেখে আজও, আমার সেই বিস্ময় ভরা চোখ দুটি কোথায় কোন হাটের ভিড়ে খোয়ালাম আমি?  উঠে চলে আসি আর ছাদ থেকে মাঠের দিকে তাকিয়ে খুঁজি সেই সেদিনের দিন রাত দুপুরগুলো। যা আমার এই জীবনের সঞ্চয়, আমার দুরন্ত ছেলেবেলা।

Leave a comment

Website Built with WordPress.com.

Up ↑